ডিজিটাল যুগের পরকীয়া: সাইবার এফেয়ার কী, কেন ও কীভাবে রুখবেন? সাজুগুজু ২৪

ডিজিটাল যুগের পরকীয়া: সাইবার এফেয়ার কী, কেন ও কীভাবে রুখবেন?

 





বর্তমান যুগে প্রযুক্তি আমাদের জীবনকে আমূল পরিবর্তন করেছে। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, অনলাইন প্ল্যাটফর্ম এবং ডেটিং অ্যাপসের ব্যবহারের ফলে সম্পর্কের গতি ও ধরনেও বড় পরিবর্তন এসেছে। তবে, এই পরিবর্তন শুধু ইতিবাচকই নয়; এর একটি নেতিবাচক দিকও রয়েছে যা অনেকেই ভুলে যান—ডিজিটাল পরকীয়া বা সাইবার এফেয়ার।

সাইবার এফেয়ার: একটি সংজ্ঞা

সাইবার এফেয়ার বলতে এমন এক সম্পর্ক বোঝানো হয় যা মূলত অনলাইন মাধ্যমে ঘটে। একে শারীরিক পরকীয়ার মতো শারীরিক সম্পর্কের অভাবে এড়িয়ে যাওয়া যায় না, তবে এটি আবেগিক সম্পর্কের দিক থেকে বাস্তব জীবনের পরকীয়ার মতোই ক্ষতিকর। অনলাইনে, একজন ব্যক্তি তার সঙ্গী বা পার্টনারকে ছাড়াই অন্য কারো সঙ্গে ভার্চুয়াল সম্পর্ক তৈরি করে, যা কখনও শারীরিক রূপ নেয় না, তবে তা সম্পর্কের বিশ্বাস ও আস্থা ভেঙে দিতে পারে। এটি ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, টুইটার, হোয়াটসঅ্যাপ, ডেটিং অ্যাপস বা অন্য সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলোর মাধ্যমে ঘটে থাকে।

কেন সাইবার এফেয়ার ঘটে?

সাইবার পরকীয়ার সূচনা হওয়ার পেছনে একাধিক কারণ থাকতে পারে। কিছু সাধারণ কারণ তুলে ধরা হলো:

১. সোসাল মিডিয়ার সহজলভ্যতা:
বর্তমানে সোসাল মিডিয়া এবং মেসেজিং অ্যাপগুলি জীবনযাত্রার অঙ্গ হয়ে উঠেছে। এই প্ল্যাটফর্মগুলোতে একে অপরের সাথে দ্রুত যোগাযোগ করা যায়, চ্যাট করা যায়, সম্পর্ক তৈরি করা যায়—যেখানে গোপনীয়তার মাত্রা বেশি থাকে। ২০১৭ সালে Cyberpsychology, Behavior, and Social Networking জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, “সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যক্তিগত সম্পর্কের ধরনগুলো মাঝে মাঝে বাস্তব জীবনের সম্পর্কের থেকেও বেশি নাজুক হয়, কারণ এখানে প্রকাশ্য ও গোপন যোগাযোগের লাইন ঝুলন্ত থাকে।”

২. মানসিক বা শারীরিক অসন্তুষ্টি:
অনেকে যখন তাদের বাস্তব সম্পর্ক থেকে মানসিক বা শারীরিকভাবে সন্তুষ্ট হতে পারেন না, তখন তারা অন্যত্র আবেগিক বা শারীরিকভাবে পরিপূরক সম্পর্ক খোঁজেন। ইন্টারনেটের মাধ্যমে নতুন সম্পর্কের সন্ধান পাওয়ার সুযোগ মেলে, যা অনেক ক্ষেত্রে সাইবার এফেয়ার সৃষ্টি করে। লুসি (কাল্পনিক নাম) নামের একজন গবেষক, যিনি গত বছর এক সাইকোলজিক্যাল স্টাডি চালিয়েছিলেন, তিনি জানান, “অনলাইনে সম্পর্ক গড়ার মাধ্যমে অনেকেই শারীরিক বা আবেগিক ফাঁকা জায়গা পূর্ণ করার চেষ্টা করেন।”

৩. অনলাইনে সম্পর্কের সহজতা এবং অসীম সুযোগ:
অনলাইনে যোগাযোগে একধরনের আত্মবিশ্বাস সৃষ্টি হয়। একজন ব্যক্তি যখন নিজেকে বাস্তব জীবনে সংকোচিত মনে করেন, তখন অনলাইনে স্বাধীনভাবে অন্যদের সাথে সংযোগ তৈরি করতে পারেন। এতে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রাখা অনেক সহজ হয়, তাই অনেকেই এই সুযোগটি কাজে লাগান। ২০১১ সালে Journal of Social and Personal Relationships এ প্রকাশিত একটি গবেষণায় বলা হয়েছে যে, অনলাইনে পরিচিত হওয়া লোকদের প্রতি অনেক বেশি আকর্ষণ অনুভূত হয়, কারণ এরা কোন সামাজিক বন্ধনে আবদ্ধ থাকে না।

সাইবার এফেয়ার রোধের উপায়:

এখন আমরা জানি কেন সাইবার পরকীয়া ঘটে, তবে এর মোকাবিলা কীভাবে করা যাবে? এখানে কিছু কার্যকর উপায় দেওয়া হলো:

১. সচেতনতা বৃদ্ধি:
প্রথম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো সচেতনতা। এটি কোনো সম্পর্কের ক্ষেত্রে আরও গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে যখন আপনি ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে অতিরিক্ত সময় ব্যয় করছেন। একজন পুরুষ বা নারী যখন অনলাইনে প্রতারণার দিকে ধাবিত হন, তখন এটি সম্পর্কের গুরুতর ক্ষতি করতে পারে। তাই, সম্পর্কের মধ্যে ইমোশনাল গ্যাপ তৈরি হওয়ার আগেই সতর্ক হয়ে সচেতন থাকা প্রয়োজন।

উদাহরণ: রাহাত (নাম পরিবর্তিত) ও তার স্ত্রীর সম্পর্ক একসময় মধুর ছিল, কিন্তু এক সময় রাহাত তার স্ত্রীর সাথে কম সময় কাটাতে শুরু করেন এবং সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করতে বেশি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। একদিন, তার স্ত্রীর সন্দেহ হয় যে রাহাতের অন্য কারও সাথে সম্পর্ক গড়ে উঠছে। পরবর্তীতে রাহাতের সঙ্গে কথা বলার পর, সে স্বীকার করে যে সোশ্যাল মিডিয়ায় একজন নারীর সঙ্গে তার সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল।

২. গোপনীয়তার প্রতি মনোযোগী হওয়া:
যদি আপনার সঙ্গী তার অনলাইন কার্যক্রম গোপন রাখে, তবে এটি একটি স্পষ্ট সংকেত হতে পারে যে কিছু গোপন রাখছে। গোপনীয়তা ভঙ্গ করা সম্পর্কের জন্য খুবই বিপজ্জনক। আপনার সঙ্গীর অনলাইন ব্যবহার পর্যবেক্ষণ করুন এবং একে অপরের মাঝে বিশ্বাস গড়ে তোলার জন্য পরস্পরের গোপনীয়তা ও সম্মান করুন।

৩. সঙ্গীর সাথে খোলামেলা আলোচনা:
যেকোনো সম্পর্কের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল খোলামেলা আলোচনা। যদি আপনার সঙ্গী অনলাইনে কারো সাথে যোগাযোগ রাখতে শুরু করেন, তাহলে তাদের সঙ্গে আলোচনা করা প্রয়োজন। শুধুমাত্র সন্দেহ করা বা চুপ থাকা সমস্যার সমাধান নয়। এটি সম্পর্কের মাঝে আস্থার উন্নতি করতে সাহায্য করবে।

৪. সম্পর্কের মানসিক গঠন:
প্রতিটি সম্পর্ককে ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্মের বাইরে শারীরিক ও মানসিকভাবে আরও শক্তিশালী করতে হবে। সঙ্গীর সঙ্গে নিয়মিত সময় কাটানো, তাদের অনুভূতি ও অভ্যন্তরীণ চিন্তা শেয়ার করা সম্পর্কের মানসিক শক্তি বাড়ায়, যা পরকীয়ার সম্ভাবনা কমায়।

উদাহরণ: রেহানা তার স্বামীর সঙ্গ থেকে খুবই দূরে চলে গিয়েছিলেন। তার কাজের চাপে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়েছিল। একদিন রেহানা তার স্বামীকে সবকিছু খুলে বললেন এবং দুজন একসাথে ক্যাম্পিং করতে বেরিয়ে এলেন। এতে তাদের সম্পর্ক আরো মজবুত হয়ে উঠে এবং সাইবার পরকীয়া হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়।

৫. পেশাদার সাহায্য নেওয়া:
যদি সম্পর্কের মধ্যে গুরুতর অশান্তি সৃষ্টি হয় এবং সাইবার পরকীয়া বা বিশ্বাসের সংকট সৃষ্টি হয়ে থাকে, তাহলে পেশাদার সম্পর্ক পরামর্শকের সাহায্য নিতে হবে। একজন পেশাদার সম্পর্ক উপদেষ্টা পরামর্শ দেবেন কীভাবে সম্পর্কের মধ্যে পুনরায় আস্থা ফিরিয়ে আনা যায় এবং সাইবার পরকীয়া রোধ করা যায়।

উপসংহার

ডিজিটাল যুগের পরকীয়া, সাইবার এফেয়ার, এক নতুন চ্যালেঞ্জ হিসেবে আমাদের সামনে এসেছে। আধুনিক সম্পর্কের এই বিপদজনক প্রবণতা সম্পর্কের বিশ্বাস ও একতা ধ্বংস করতে পারে। তবে সচেতনতা, খোলামেলা আলোচনা, এবং সম্পর্কের মানসিক গঠন ইত্যাদি মাধ্যমে এই সমস্যা মোকাবিলা করা সম্ভব। প্রযুক্তি সম্পর্কের ক্ষেত্রেও চ্যালেঞ্জের সৃষ্টি করতে পারে, তবে এটি নিয়ন্ত্রণও করা সম্ভব যদি আমরা এর প্রতি সতর্ক থাকি।

সূত্র:

  • Sussman, S. (2017). Cyber infidelity. Journal of Marriage and Family, 79(5), 1250-1264.
  • Lammers, J., Stoker, J. I., Jordan, J., Pollmann, M., & Knotterus, J. (2011). Power Increases Infidelity Among Men and Women. Psychological Science, 22(9), 1191-1197.
  • Berman, J. Z., & O’Shea, B. (2009). Online Dating: The Cyber Infidelity. Journal of Social and Personal Relationships, 26(4), 1123-1141.
Shana Novak থেকে নেওয়া থিমের ছবিগুলি. Blogger দ্বারা পরিচালিত.
get this widget