পরকীয়ার বলি সন্তানেরা সাজুগুজু ২৪

পরকীয়ার বলি সন্তানেরা

 



পরকীয়া, যা দাম্পত্য সম্পর্কের বাইরের অবৈধ সম্পর্ককে বোঝায়, শুধুমাত্র স্বামী বা স্ত্রীর মধ্যে সম্পর্কের অবনতির কারণ হয়ে দাঁড়ায় না, বরং এর প্রভাব সন্তানের উপরও গভীরভাবে পড়ে। একটি সম্পর্কের মধ্যে পরকীয়া হলে, সেই অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা এবং শোষণের ফলে সন্তানের মানসিক ও আবেগিক অবস্থা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। সন্তানরা, বিশেষত ছোট বয়সে, বাবা-মায়ের সম্পর্কের মধ্যে এমন অশান্তি দেখে কেবল তাদের মানসিকতা নয়, পুরো জীবনের দৃষ্টিভঙ্গি বদলে যেতে পারে।

১. বাবা-মায়ের মধ্যে সম্পর্কের অস্থিরতা

পরকীয়া একটি সম্পর্কের ভিতকে দুর্বল করে দেয়, এবং সন্তানরা এই অস্থিরতা সহজেই অনুভব করতে পারে। তারা যখন প্রতিদিন তাদের বাবা-মায়ের মধ্যে ঝগড়া, মানসিক চাপ বা অবিশ্বাস দেখতে পায়, তখন তাদের মধ্যে অসন্তোষ ও উদ্বেগ বৃদ্ধি পায়। সন্তানরা অনেক সময় ভাবতে থাকে যে, তাদের মধ্যে কেন এই অশান্তি এবং এটি তাদের কেন প্রভাবিত করছে।

উদাহরণ: রুহি, ১০ বছরের একটি মেয়ে, তার বাবা-মায়ের মধ্যে অশান্তি দেখে আসছে। তার বাবা তার মায়ের প্রতি পরকীয়া করছিল, এবং রুহি তাদের মধ্যে কথা-কাটাকাটি ও ঝগড়া শুনে কষ্ট পেত। সে ভাবতে শুরু করেছিল, "কেন বাবা-মা একে অপরকে ভালোবাসে না? আমি কি তাদের ভালোবাসার জন্য যথেষ্ট নই?"

২. আত্মবিশ্বাস এবং নিরাপত্তাহীনতা

পরকীয়ার কারণে সন্তানের মধ্যে আত্মবিশ্বাসের অভাব তৈরি হতে পারে। তারা মনে করতে পারে যে তাদের পরিবার "অহরহে" বা অস্থিতিশীল, এবং এমন পরিবারের মধ্যে বড় হওয়া তাদের নিরাপত্তাহীনতার অনুভূতি তৈরি করতে পারে। সন্তানের মনে এমন প্রশ্ন আসে, "যদি বাবা-মা একে অপরকে ভালোবাসে না, তাহলে তারা আমাকে ভালোবাসে কি না?"। এই প্রশ্ন তাদের মনে চাপ এবং সন্দেহের সৃষ্টি করে।

উদাহরণ: শাওন, ১৫ বছর বয়সী এক ছেলে, তার বাবা-মায়ের মধ্যে অবিশ্বাস এবং পরকীয়া দেখে বড় হচ্ছে। সে নিজেকে প্রশ্ন করতে থাকে, "আমি কি আমার পরিবারে নিরাপদ? বাবা-মা যদি একে অপরকে ভালোবাসে না, তাহলে আমি কি তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ?"

৩. অবৈধ সম্পর্ক এবং সমাজের প্রতি মনোভাব

পরকীয়ার কারণে, সন্তানরা নিজেদের মূল্যবোধ, সম্পর্ক এবং সামাজিক কাঠামো সম্পর্কে একটি নেতিবাচক ধারণা পেতে পারে। তারা যখন দেখে যে তাদের বাবা-মা পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়েছেন, তখন তারা সম্পর্কের প্রতি অবিশ্বাসী হয়ে ওঠে এবং পরে জীবনের বাকি অংশে তাদেরও সম্পর্কের প্রতি নেতিবাচক মনোভাব সৃষ্টি হতে পারে।

উদাহরণ: অর্ণব, ১৮ বছরের একজন তরুণ, তার বাবার পরকীয়ার কারণে সম্পর্কের প্রতি হতাশ হয়ে পড়ে। সে বিশ্বাস করে না যে সত্যিকার ভালোবাসা এবং আস্থা সম্ভব। তার মানসিকতায় এক ধরনের বিভ্রান্তি এবং শূন্যতা সৃষ্টি হয়, যা তার নিজের সম্পর্ক গড়তে বাঁধা সৃষ্টি করে।

৪. পরিবারের বিচ্ছেদ এবং মানসিক চাপ

যখন পরকীয়া প্রকাশ পায়, তখন এটি অনেক সময় পারিবারিক বিচ্ছেদের দিকে নিয়ে যায়। এই পরিস্থিতিতে সন্তানের ওপর চাপ পড়তে থাকে, বিশেষত যদি তারা বাবা-মায়ের বিচ্ছেদের শিকার হয়। সন্তানের মনোভাবে গভীর ক্ষত সৃষ্টি হয়, যা তাদের ভবিষ্যতের সম্পর্কের ধারণা এবং আত্মবিশ্বাসকে প্রভাবিত করে।

উদাহরণ: তানিয়া, ১৩ বছর বয়সী একটি মেয়ে, তার বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ ঘটেছিল। এর পেছনে পরকীয়ার ভূমিকা ছিল, এবং তানিয়া অনুভব করেছিল যে সে তার বাবা-মায়ের বিচ্ছেদে দায়ী। তার মনে হত, "যদি আমি আরও ভালো মেয়ে হতাম, তাহলে হয়তো তারা একে অপরকে ছেড়ে যেত না।"

৫. আবেগিক অস্থিরতা এবং শৃঙ্খলাহীনতা

পরকীয়ার বলি সন্তানেরা প্রায়ই আবেগিক অস্থিরতার শিকার হয়। তারা গভীরভাবে আঘাতপ্রাপ্ত এবং তাদের নিজের সম্পর্কের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ও বিশ্বাসের অভাব অনুভব করতে থাকে। অনেক সময় সন্তানেরা নিজেদেরকে বিচ্ছিন্ন অনুভব করে এবং তাদের শৃঙ্খলা এবং আবেগিক স্থিরতা নষ্ট হয়ে যায়।

উদাহরণ: রাহুল, ১১ বছর বয়সী একটি ছেলে, তার মায়ের পরকীয়ার কারণে তার পরিবারের মাঝে মানসিক অস্থিরতা অনুভব করে। সে সাধারণত মেঝেতে বা এক কোণে বসে থাকত, এবং কোন কিছুতে মনোযোগ দিতে পারত না। তার সহপাঠীরা এবং শিক্ষকরা লক্ষ্য করেছিল যে সে ক্লাসে আগের মতো অংশগ্রহণ করত না এবং তার মধ্যে এক ধরনের বিষণ্নতা ছিল।

৬. মানসিক অসুস্থতা এবং আস্থাহীনতা

অধিকাংশ ক্ষেত্রে, পরকীয়ার বলি সন্তানেরা মানসিক সমস্যার শিকার হয়ে থাকে। তাদের মধ্যে বিষণ্নতা, উদ্বেগ, স্নায়ুবিক চাপ এবং সম্পর্কের প্রতি আস্থাহীনতা বাড়তে থাকে। তারা তাদের অনুভূতিগুলো প্রকাশ করতে ভয় পায় এবং ভবিষ্যতে সম্পর্কের ক্ষেত্রে তাদের সহানুভূতি এবং আস্থায় শূন্যতা অনুভব করে।

উদাহরণ: সাবিনা, ১৬ বছর বয়সী একটি মেয়ে, তার মায়ের পরকীয়ার কারণে মানসিকভাবে বিচলিত হয়ে পড়ে। সে নিজের মনোভাব এবং অনুভূতিগুলো সঠিকভাবে প্রকাশ করতে পারছিল না এবং নিজের আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছিল।


উপসংহার

পরকীয়ার প্রভাব কেবলমাত্র স্বামী-স্ত্রী বা সম্পর্কের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না, বরং এটি সন্তানদের ওপরও এক গভীর এবং দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলে। তাদের মানসিকতা, আত্মবিশ্বাস এবং ভবিষ্যতের সম্পর্কের ধারণা অনেকটাই এই অভিজ্ঞতার দ্বারা প্রভাবিত হয়। সুতরাং, একজন অভিভাবক হিসেবে পরকীয়ার কোনো ধরনের প্রভাব ছাড়াই একটি সুস্থ এবং শান্তিপূর্ণ সম্পর্ক গড়ার প্রচেষ্টা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যাতে সন্তানদের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত এবং সুস্থ থাকে।

Shana Novak থেকে নেওয়া থিমের ছবিগুলি. Blogger দ্বারা পরিচালিত.
get this widget