সুন্দরী হবার চাইতে সুখী হওয়াটা অনেক বেশী জরুরীঃ সোনম কাপুর
"আরও অনেক মেয়ের মতো আমিও আমার কৈশোরের অনেকগুলো রাত পার করেছি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে। দিনের পর দিন আমি শুধু ভেবেছি, কেন আমার ফিগার সিনেমার নায়িকাদের মতো সুন্দর নয়, কেন আমার ত্বক ওদের মতো উজ্জ্বল নয়। কেন আমার পেট বেরিয়ে থাকে? কেন হাঁটার সময় আমার হাতগুলো ঝাঁকি খায়, কেন আমি ধবধবে ফর্সা নই, কেন আমার চোখের চারপাশে কালো দাগ? কেন আমি আমার বয়সের ছেলেদের চেয়েও বেশী লম্বা? আমার গাল আর কপালজুড়ে থাকা বিচ্ছিরি দাগগুলো কি কোনদিন দূর হবে? নাকি সারাজীবন এই কুৎসিত রেখাগুলোকে সঙ্গে নিয়েই চলতে হবে আমাকে?
পারিবারিক একটা অনুষ্ঠানে এক আত্মীয়া আমাকে দেখে বলেছিলেন- "এত কালো! এত লম্বা! একে কে বিয়ে করবে?" নিজেকে নিয়ে আমি যেসব হীনম্মনতায় ভুগতাম, সেগুলোকে আরও শক্তিশালী করে তুলেছিল এই মন্তব্যটা। আমি বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলাম যে, আসলেই আমি দেখতে বেঢপ এবং বেখাপ্পা।
আমার বয়স যখন তেরো বছর, তখন আমরা গোয়া গিয়েছিলাম ফ্যামেলি ট্রিপে। ঐশ্বরিয়া রাইও তখন ছুটি কাটাচ্ছিলেন গোয়াতে। এক সন্ধ্যায় উনি আমাদের সঙ্গে ডিনার করলেন। আমি এখনও মনে করতে পারি, ওর পরনে ছিল নীল জিন্স আর একটা সাদা ট্যাংক টপ। ওকে দেখেই মনে হচ্ছিল, অসম্ভব অভিজাত একটা মানুষ চারদিক আলো করে বসে আছে। আমি হতবুদ্ধি হয়ে গিয়েছিলাম ওর সৌন্দর্য্য দেখে! পনেরো বছর বয়সে আমি খুব বেশী কিছু বুঝতাম না, কিন্ত এটা স্পষ্ট বুঝতাম যে, বলিউডের কোন নায়িকার সিকিভাগ সৌন্দর্য্যও আমার মধ্যে নেই, আমি কোনদিন নায়িকা হতেও পারবো না।
অথচ এর ঠিক দুই বছর পরেই গল্পটা কেমন অদ্ভুতভাবে বদলে গেল, জীবন আমাকে দেখিয়ে দিলো, আমি কত বড় ভুল ধারণা নিয়ে বসে ছিলাম! সঞ্জয় লীলা বানশালি আমাকে 'সাওয়ারিয়া' সিনেমার জন্যে কাস্ট করলেন।
বানশালির সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পাওয়াটাকে আমি শিখরে ওঠা ভাবিনি সত্যি, কিন্ত নিজেকে ফিল্মি দুনিয়ার একজন ভাবতেও আমার অদ্ভুত লাগছিল, কেন যেন বিশ্বাসই হচ্ছিল না। নিজেকে এই দুনিয়ায় অচ্ছ্যুৎ হিসেবেই ভাবতাম আমি, মনে হতো, আমি যখন পিঠখোলা ঘাগড়া-চোলি পরে নাচবো, আমার কোমর আর পিঠের মেদ দেখে লোকে হাসবে। কেউ টাকা দিয়ে টিকেট কিনে আমার সিনেমা দেখতে যাবে, এরকম কিছু ভাবতেও অবাক লাগতো আমার। আর এটা ভেবেই আমি ডায়েট করা শুরু করলাম।
চকলেট আমার ভীষণ প্রিয় ছিল, সেটা ছাড়তে হলো শুরুতে। চিনি ছাড়লাম, ব্যায়াম করতে শুরু করলাম পার্সোনাল ইনস্ট্রাক্টর রেখে। ডায়েট চার্ট ঠিক করার জন্যে কেউ ছিল না শুরুতে, এমনও হয়েছে, শুধু কয়েক স্লাইস আনারস খেয়েই আমি গোটা দিন পার করে দিয়েছি। মনের সঙ্গে যুদ্ধ করে আমি ক্ল্যাসিক্যাল ড্যান্সের ক্লাসে ভর্তি হয়েছিলাম, একটানা ঘন্টার পর ঘন্টা পাওয়ার ইয়োগা করে গিয়েছি, আমার সব প্রিয় খাবারের সাথে আড়ি দিয়েছি, এক বছর আগেও যেগুলো ছাড়া বেঁচে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব হতো না।
কয়েক সপ্তাহ এগুলো চলার পরে দেখলাম আমার ওজন মাত্র দুই কেজি কমেছে! আমি খুবই অবাক হলাম, একেবারে না খেয়ে এতকিছু করে বেড়াচ্ছি, আর ওজন কমলো কিনা শুধু দুই কেজি! আঠারো বছর বয়সে একটা ছেলে আমাকে ডেটে নিমন্ত্রণ করেছিল, সন্ধ্যায় তার সঙ্গে দেখা করলাম আমি, একসঙ্গে ডিনার করলাম। আমি যা খেয়েছিলাম সেটার ওজন সব মিলিয়ে একশো গ্রামও হবে না। দুইদিন পরে ছেলেটা আমার এক বন্ধুর কাছে বলেছিল, আমি নাকি অতিরিক্ত মোটা! এটা শোনার পরে আমি পুরোটা দিন পানিও মুখে দেইনি। এইরকম মানসিকতার মানুষগুলোর জন্যেই গ্যাস্ট্রিকের সমস্যাটা আমার চিরস্থায়ী সঙ্গী হয়ে গেছে। এখন আমি সেই গর্ধবটাকে ধন্যবাদ দেই, এসব লোকজন হচ্ছে পেটের অ্যাসিডিটির মতো, এদের সঙ্গে যতো কম থাকা যায়, ততো কম যন্ত্রণা সঙ্গী হয় মানুষের।
তখন আমি ভাবতাম, কোনদিন যদি জুহু বীচের ধারে বিলবোর্ডে নিজের ছবি টাঙানো দেখতে পাই, তাহলে হয়তো আমার এসব শিশুতোষ হীনমন্যতাগুলো কেটে যাবে। কিন্ত এই ভাবনাটাও যে একটা শিশুতোষ ভুল ধারণা ছিল, সেটা তখন বুঝতাম না। একবার যখন নায়িকার জীবনটায় আমি ঢুকে গেলাম, তখন বুঝলাম, নিজেকে যতোটা ফেলনা আমি মনে করি, মানুষের চোখে ততটা ফেলনা আমি নই। আর তখন থেকেই আমার আত্মপ্রেমের শুরু।
আমি তখন কয়েকটা সিনেমা করেছি, একদিন শুনলাম শোভা দে কোথাও ব্লগে লিখেছেন- সোনম কাপুর কখনও যৌন আবেদনময়ী হতে পারবে না। কিছু মানুষ আমাকে সমতল বক্ষের নায়িকা হিসেবে নাম দিয়ে দিলো। আমি কখনোই আমার ব্রা'য়ের সাইজ নিয়ে চিন্তিত ছিলাম না, সেটার কাপসাইজ সি নাকি ডি সেসব নিয়ে মাথা ঘামানোর প্রয়োজন আছে বলে মনে করিনি, কিন্ত এসব নিয়েও যে কথা বলা যায়, গালগল্প রটানো যায়, সেটা ফিল্মসিটিতে প্রবেশ করার আগে জানা ছিল না।
নারীর শরীর নিয়ে কাটাছেড়া করাটা আজ নতুন তো নয়। সেলিব্রেটিদের মধ্যে এটা নিয়ে কোন সংকোচ আছে বলেও শুনিনি কোনদিন। শপথ করে বলুন তো, কখনও কোন আত্মীয়ের মুখে আপনি মোটা- এই অপবাদটা শোনেননি? কীভাবে ওজন কমানো যায় এই নিয়ে কোন বন্ধু আপনাকে বিরক্তিকর জ্ঞান দেয়নি কোনদিন? ঘর থেকে রোদে বের হলে আপনার ত্বক পুড়ে যাবে, এই ভয়ে আপনাকে বাড়ি থেকে বেরুতে নিষেধ করা হয়নি একটা দিনও? আপনাকে বেঢপ বা বিশ্রী বলে কেউ মজা নেয়নি কখনও? মাথায় হাত রেখে বলতে পারবেন আপনি, পরীর মতো সুন্দরী না হলে সমাজের কোন মেয়েটাকে এসব পরিস্থিতিতে পড়তে হয়নি?
আমাদের সিনেমাজগত, বা গ্ল্যামার ওয়ার্ল্ডের পুরোটাই মেয়েদের শুধু সুন্দরী আর আবেদনময়ী হিসেবেই দেখাতে চায়। অথচ আবেদনময়ীর সংজ্ঞাটাই জানি না আমরা কেউ। আমাদের নায়িকারা জুরাসিক পার্কে হাইহিল পরে দৌড়ায়, বাঁধনহীন কাঁচুলী পরে সুপারভিলেনের সঙ্গে মারপিট করে, তাকে মেরে ভর্তা বানিয়ে দেয়, মরুভূমির রোদে পুড়েও আমাদের নায়িকাদের ত্বকে এতটুকু মলিন ভাব আসে না। কেমন অদ্ভুত না?
নারী শরীর নিয়ে ট্যাবু ব্যপারটা এখানে এতই বেশী যে, সবার ধারণা 'সেক্সি' বডি মানেই সেখানে কোন ধরণের লোম থাকা যাবে না। আরে, হেয়ার রিমুভাল ক্রীমের অ্যাডে যে হাত পায়ের ছবি আপনারা দেখেন, সেটাতে তো ক্রিমটা লাগানোই হয় না। কত কারসাজী করে কত সময় নিয়ে যে মডেলকে প্রস্তত করা হয়, সেটা যদি সবাই জানতো! সৌন্দর্য্যের যে সংজ্ঞা আর স্ট্যান্ডার্ড এখানে ঠিক করে দেয়া আছে, সেই মানদণ্ডে আসলে কেউই সুন্দরী নয়। একেকজন একেক রকম, আনুশকার স্কিনী বডি, সোনাক্ষীর একটু ফ্যাট-শেমড বডি(এটা নিয়েও বেচারীকে কম কথা শুনতে হয়নি, এখনও শোনা লাগে), ক্যাটরিনার আবার ফিট বডি- ওরা কেউ কারো মতো নয়, কিন্ত প্রত্যেকেই ভিন্ননরকম ভাবে সুন্দর। তাহলে কোন নির্দিষ্ট মানদন্ডকে অনুসরণ করলে তো তিনজনের কাউকে সুন্দরীর তালিকা থেকে বাদ পড়তেই হবে, তাই না?
আমার মনে হয়, সৌন্দর্য্য পরিমাপক নিয়ে যে সংজ্ঞাটা পুরুষশাসিত সমাজ ঠিক করে দিয়েছে, এটা ভাঙার মাধ্যমেই এর সমাধান হতে পারে। আর এই সমাধানটা শুধু নারীরাই করতে পারে। তাই যেসব কিশোরী মেয়েরা রোজ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে এটা ভেবে মন খারাপ করো যে, কেন তোমার ফিগার নায়িকার মতো নয়, কেন তোমার চুল কোমর সমান লম্বা নয়, তারা প্লিজ এগুলো ভাবা বন্ধ করো। ঘুম থেকে যখন আমি জেগে উঠি, তখন আমাকে দেখতে মোটেও তোমাদের চেয়ে বেশী সুন্দর লাগে না। এমনকি বিয়োন্সের বেলাতেও এটাই সত্যি। আসল সত্যিটা কি জানো? প্রতিটা পাবলিক অ্যাপিয়ারেন্স বা অনুষ্ঠানে যাওয়ার আগে আমাকে দেড় ঘন্টা ধৈর্য্য ধরে মেকাপ রুমের চেয়ারে বসে থাকতে হয়। আমার প্রসাধনী আর চুল নিয়ে ছ'টা মানুষ কাজ করে, একজন পড়ে থাকে আমার নখের যত্ন নিয়ে। সপ্তাহে একবার করে চোখের পাপড়ি ডিজাইন করে ছাঁটা হয়। তোমাদের সামনে গ্ল্যামারাস 'সোনম কাপুর' সেজে আসাটা তো চাট্টেখানি কথা নয়।
প্রতিদিন সকালে নিয়ম করে ভোর ছ'টায় আমাকে ঘুম থেকে উঠতে হয়, দেড়ঘন্টা সময় বরাদ্দ থাকে আমার ব্যায়ামের জন্যে। সেই সময় থেকে শুরু করে রাতে আমি ঘুমাতে যাওয়ার আগে পর্যন্ত একটা মানুষের দায়িত্ব থাকে সারাদিনে আমি কী খাবো কী খাবো না সেসবের চার্ট আমাকে বুঝিয়ে দেয়া, এবং খাওয়ার সময় আমার পাশে থাকা, যাতে ক্যালরীর পরিমাণ ঠিক আছে কিনা সেটা সে চেক করতে পারে। যতটুকু না আমি খাই, তারচেয়ে বেশী খাবারের জিনিস ব্যবহার করা হয় আমার মুখের ফেসপ্যাক বানাতে। আমি কী পরে কোন অনুষ্ঠানে যাবো, বীচে যাওয়ার সময় আমার গায়ে কী পোষাক থাকবে, প্লেনে চড়ার সময় আমার আউটফিট কী হবে, এসবকিছু ঠিক করার জন্যে আলাদা একটা টিমই আছে।
এতসবকিছু করার পরেও কিন্ত আমি নিখুঁত সুন্দরী নই, সেটার জন্যে ফটোশপ আছে। পত্রিকার পাতায় বা ক্যালেন্ডারে যাতে আমাকে অপ্সরীর মতো সুন্দরী দেখায়, সেজন্যে এডিট করে আমার শরীরকে আরও গ্ল্যামারাস করে তোলা হয়। আমি আগেও এটা বলেছি, এখনও বলছি- একজন নারী সেলিব্রেটিকে খানিকটা সময়ের জন্যে নিখুঁত সৌন্দর্য্যের অধিকারী করে তুলতে অনেকগুলো মানুষের অক্লান্ত পরিশ্রম, অসীম সময় আর প্রচুর অর্থের প্রয়োজন। এমন কাউকে যখন তুমি দেখবে, অবশ্যই একটা জিনিস মাথায় রাখবে, এটা বাস্তব কিছু নয়। পুরোটাই এক ধরণের ভ্রমের মতো। এটা দেখে অনুপ্রাণিত হবার কিছুই নেই, পুরো ব্যপারটাই কৃত্রিমতার চাদরে মোড়ানো।
শারীরিক সৌন্দর্য্যটা কখনও সাফল্যের সিঁড়ি হতে পারে না। কৃত্রিম সৌন্দর্য্যের পেছনে না ছুটে লক্ষ্যের দিকে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে ছুটে চলো, সাফল্যে তোমার হাতেই ধরা দেবে, যদি সত্যিই তুমি সেটাকে চেয়ে থাকো। সুন্দরী হবার চাইতে সুখী হওয়াটা অনেক বেশী জরুরী। এরপরে যখনই তুমি তেরো বছর বয়েসী কোন কিশোরীকে অদ্ভুত চোখে ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদে আসা সুন্দরী মডেলের ছবির দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখবে, অবশ্যই তাকে এটা জানিয়ে দেবে যে, পুরো ব্যপারটা কতটা জটিল, কতখানি মিথ্যে লুকিয়ে আছে এর পরতে পরতে। তাকে জানিয়ে দিও, ওর ছোট্ট মুখের হাসিটা কত সুন্দর, তার ভেতরের সুন্দর মনটার খোঁজ তাকে জানিয়ে দিও। একটা মিথ্যে কল্পনাকে আশ্রয় করে ওর স্বপ্নগুলোকে ডালপালা মেলতে দিও না, ওর ভ্রান্ত বিশ্বাসগুলো খুব যত্নের সাথে ভেঙে দিও। যে স্বপ্নের চারপাশটা কুৎসিত কদাকারে ঢাকা, সেটা পূরণ না হওয়াই তো ভালো..."
-অসম্ভব পাওয়ারফুল একটা স্টেটমেন্ট, বিশেষ করে বলিউডের মতো জায়গায়, যেখানে চেহারা, গায়ের রঙ আর ফিগারটা নায়িকাদের জন্য সবকিছু। সোনম কাপুর নিজেও অজস্র বিউটি প্রোডাক্টের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর, নিয়মিতই 'রঙ ফর্সাকারী ক্রিম' বা 'ত্বকে ঔজ্জ্বল্য এনে দেয়া' সাবানের বিজ্ঞাপনে দেখা যায় তাকে। সেই অবস্থানে দাঁড়িয়ে অকপটে সত্যি কথাগুলো বলার সাহস সোনম করেছিলেন, প্রায় বছর চারেক আগে, বাজফিড ডটকমে লেখা বিশাল একটা কলামে।
posted from Bloggeroid